নাঈম হাবিব, জার্মানি থেকেঃ
জার্মানিতে কয়েকটা কবরস্থান ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। ছোটবেলা থেকে কবরস্থান নিয়ে গা ছমছমে নানা গল্প শুনে এসেছি। অথচ এই সেমিটারিগুলো দেখে আমার কখনই কোনো গা শিউরে উঠা অনুভূতি হয়নি।
দেশের কবরস্থান দিয়েই গল্প শুরু করি। দেশের এক কবরস্থানে একবার দেখলাম মৃতমানুষদের হাড্ডি-গুড্ডি কবরের উপর পরে আছে। কবরে গর্ত। অপরিষ্কার জরাজীর্ণ অবস্থা। সেখানে দিনেরবেলায় যাওয়ার সাহস হয়তো মানুষে পান না। যদি কেউ রাতেরবেলা কবরস্থান ঘুরে আসতে পারেন তাহলে তাকে সাহসী মানুষ হিসেবেই ধরা হয়।
এদেশের কবরস্থানগুলো অনেক সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফুলে ফুলে সাজানো। বাগানের মতো। প্রত্যেকটা কবরে নামফলক লাগানো রয়েছে। এসব পড়তে ভালো লাগে। রহস্য গল্পের মতো লাগে। স্বামীর পাশে স্ত্রীর, স্ত্রীর পাশে স্বামীর কবর রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ মারা গিয়েছেন বিশ বছর আগে পরে। প্রিয়জনহীন বিশটি বছর কাটিয়ে গেছেন একাকী। তারপর আবার হয়েছেন পাশাপাশি, পঞ্চাশ বছর হয়। কবরের এসব নামফলক পড়লে একেকটা কাহিনীর মতো মনে হয় আমার কাছে। দেখতে কেমন ছিলেন এসব মানুষ? কেমন জীবনযাপনই বা করেছেন তারা তখন? এসব ভাবি আমি।
আমার দাদা মারা গেছেন হয় বিশ বছর। দাদি গেছেন গত বছর। একসঙ্গে দুজনের নিশ্চয়ই ভালোই কাটছে এখন। বিশ বছরের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সব গল্পকথা এই একবছরে দাদি দাদাকে বলে শেষ করেছেন নিশ্চয়ই!
একসঙ্গে একই পরিবারের সদস্যদের কিছু কবর দেখলাম। সবার মৃত্যু তারিখ একই। নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন সবাই। অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছে এমন কিছু মানুষের কবর দেখলাম। আমি অঙ্ক করি, বেঁচে থাকলে এই মানুষগুলোর বয়স এখন কতো হতো? হয়তো বিয়েশাদি করতেন, ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি থাকতো। হয়তো এতদিনে মরেও যেতেন।
জার্মানিতে প্রত্যেক শনি রোববার মানুষ যান কবরপাড়ায়। কেউ কেউ প্রতিদিনই যান। ঝাড়ু দেন, লণ্ঠন জ্বালিয়ে আসেন। ফুল দিয়ে আসেন। ফুলগাছে পানি দিয়ে আসেন। ছোটদের কবরে খেলনাসামগ্রী, পুতুল দেন অনেকে।
সম্প্রতি স্পেনের একটি কবরস্থান ঘুরে এসেছি আমি। এটি একটি অন্যরকম কবরস্থান। দক্ষিণ স্পেনের মালাগা প্রদেশের তরমোলিনস শহরের প্রাণকেন্দ্রে এটির অবস্থান। প্রথমবার দেখলে ফুলের দোকান মনে হবে। এমন সুন্দর কবরস্থান আমি এর আগে কখনো দেখিনি।
মাঝখানে গলি। গলির দুই পাশে উঁচু দেয়ালের মতো। দেয়ালের মধ্যে কবর। যত যাই গলি পথ ফুরায় না। কতো কবর এখানে। কয়েক হাজার কবর হবে। সবগুলোতেই নামফলক আছে। মৃত মানুষটির ছবি লাগানো আছে। পরিবারের লোকজন আসছেন ফুল নিয়ে। মনে রাখছেন তারা কবরজগতের এই আপনজনদের।
বেঁচে থাকতে কবর ভ্রমণে ভয়। মরেও সেখানে যেতে আমাদের ভয়। মৃত্যুর পরে সব মানুষের ঠিকানা কবর। একদিন যেতে তো হবে সবাইকেই। তবে এমন কবরে থাকতে আমার নেই কোনো ভয়।